বাঙালি এবং বাংলাদেশের ইতিহাসে বায়ান্নর মহান ভাষা আন্দোলন এক গৌরবোজ্জল ঘটনা । মাতৃভাষার অধিকার আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নেতৃত্ব দিয়েছিল। এর পেছনের মূল প্রেরণার উৎস ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এর ধারাবাহিকতায় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃতে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা পেয়েছি একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। তাই একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের সংগ্রামী চেতনাকে করে উজ্জীবিত, দেশপ্রেমকে করে জাগ্রত। একুশের স্মৃতিকে অল্লান করতে এবং ভাষা শহিদদের প্রতি সম্মান দেখাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল অমর একুশে হল । মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৪ বৈশাখ ১৪০৮ ( ৭ মে, ২০০১ ) অমর একুশে হলের উদ্বোধন ঘোষণা করেন । সেদিন তিনি হল চত্বরে একটি নিম চামেলি গাছও রোপণ করেছিলেন।
হলের প্রকল্প পরিচালক এবং প্রথম প্রাধ্যক্ষ প্রভোস্ট ছিলেন অধ্যাপক ড. সহিদ আকতার হুসাইন (কার্যকাল: ১.১.২০০১ - ৮.১০.২০০১)। এরপর যথাক্রমে অধ্যাপক ড. আখতার হোসেন খান (কার্যকাল : ৯.১০.২০০১ - ২৬.১১.২০০৭), অধ্যাপক ড. এম এ মালেক (কার্যকাল : ২৭.১১.২০০৭ - ২৬.১১.২০১৩) এবং অধ্যাপক ড. মোঃ আনোয়ারুল ইসলাম (কার্যকাল : ২৭.১১.২০১৩ - ২৬.১১.২০১৯) দায়িত্ব পালন করেছেন। হলের বর্তমান প্রাধ্যক্ষ হিসাবে আছেন অধ্যাপক ড. ইসতিয়াক এম সৈয়দ (কার্যকাল : ২৭.১১.২০১৯ - ২৬.১১.২০২২) । হলে আবাসিক ও সহকারী আবাসিক শিক্ষকের সংখ্যা যথাক্রমে ৪ জন ও ৮ জন।
ভাষা শহিদদের স্মরণে সালাম, বরকত, রফিক ও জব্বারের নামে এ হলের ৪টি ভবনের নামকরণ করা হয়েছে। ২০০১ সালের শেষের দিকে ফজলুল হক মুসলিম হল, শহীদুল্লাহ হল এবং স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম হল থেকে আগত ছাত্রদের নিয়ে অমর একুশে হলের আবাসিক কার্যক্রম শুরু হয়। রফিক, সালাম ও বরকত এই তিনটি ৫ তলা ভবনে সর্বমোট ৫০০ সিট ছিল । পরবর্তিতে ২০১৩ সালে ঐ তিনটি ভবনের ছয়তলা নির্মানের ফলে সিট সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ৬২০ হয়। বর্তমানে হলে সর্বমোট ১৫৫টি আবাসিক কক্ষ রয়েছে এবং প্রতিটি কক্ষে চারজন অবস্থানের ব্যবস্থা রয়েছে। বাস্তবে হলে ৫৭০ জন শিক্ষার্থী নিয়মানুযায়ী এবং অতিরিক্ত ১৩০ জন শিক্ষার্থী অনাবাসিক হিসেবে বসবাস করে। এছাড়াও ৮৯৫ জন অনাবাসিক শিক্ষার্থী হলে সংযুক্ত আছে।
ফ্লোর অনুযায়ী আবাসিক ও সহকারী আবাসিক শিক্ষকগণ দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও শৃঙ্খলা পরিপন্থী কাজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, সিট বরাদ্দ প্রদান, সহ-শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা ও হালনাগাদ তালিকা/ডাটাবেজ তৈরি করা আবাসিক শিক্ষকগণএর কাজের অংশ । আবাসিক ও সহকারী আবাসিক শিক্ষকগণ সন্ধ্যায় বা অন্য কোনো সময় শিক্ষার্থীদের অভিযোগ জানার জন্য নির্দিষ্ট কক্ষে বসেন এবং প্রতি সপ্তাহে ফ্লোরসমূহ সাধারণত একদিন করে পরিদর্শন করা হয়। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ বা অসুবিধা থাকলে কম সময়ের মধ্যে তার প্রতিকারের ব্যবস্থা করা হয়। হলে শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনে পোষাক-পরিচ্ছদ ও চাদর ধোপার কাছে পৌছে দেয়া হয়। এছাড়াও অসুস্থ্য শিক্ষার্থীদের টিফিন/ওষুধ কক্ষে পৌছে দেয়া সহ প্রয়োজন অনুযায়ী অন্যান্য সেবা প্রদান করা হয়।
হলে শিক্ষার্থীদের চিত্ত-বিনোদনের জন্য সংবাদপত্র, পাঠকক্ষ, টিভিকক্ষ, লাইব্রেরি সাংস্কৃতিক সংঘ ইত্যাদি রয়েছে। এছাড়াও ডিবেটিং ক্লাব, বাঁধন (স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের সংগঠন) এবং অভ্যন্তরীণ ক্রীড়ার জন্য একটি করে কক্ষ আছে। হলে শিক্ষার্থীদের প্রার্থনার জন্য ১টি মসজিদও রয়েছে।
হলের ছাত্রদের ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধার্থে হলের নিজস্ব অর্থায়ণে মোট ৪৩টি রাউটার বসানো হয়েছে। এর মাধ্যমে ছাত্ররা তারবিহীন ইন্টারনেট সুবিধা পাচ্ছে। এছাড়াও প্রায় ৫০জন ছাত্র ব্যাক্তিগত উদ্যেগে বাইরের ব্রডব্যান্ড সংযোগ ব্যাবহার করছে।
ঈদের দিন হলে অবস্থানকারী ছাত্রদের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়াও ১লা বৈশাখে বিশেষ খাবার এবং রমজান মাসে এক দিন ইফতারির ব্যবস্থা করা হয়। বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার দিনেও ছাত্রদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। হল অভ্যন্তরে খাবারের জন্য রয়েছে ছাত্রদের পরিচালিত ডাইনিং (রুচিরা) এবং ১টি ক্যান্টিন। এছাড়াও খাবারের জন্য হল অভ্যন্তরে রয়েছে একটি দোকান।
১১ই মার্চ ২০১৯ হল সংসদের প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত এবং হল সংসদ প্রতিষ্ঠিত হয়। নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে সহ-সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসাবে যথাক্রমে জনাব মোঃ মেহেদী হাসান সুমন এবং জনাব আহসান হাবীব নির্বাচিত হন। অত্যন্ত কম সময়ের মধ্যে সংসদ কক্ষ নির্মাণ করা হয় যা নির্বাচিত ১৩ জনেরই অত্যন্ত পছন্দ হয়েছে।
৭ মে, অমর একুশে হল দিবস উপলক্ষ্যে অমর একুশে হল সংসদ কর্তৃক প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হয় সাহিত্য পত্রিকা "অভিষেক"। অভিষেকের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠিত হয় ১৭ মে, ২০১৯। ৬ পৃষ্ঠার উক্ত পত্রিকায় হলের বর্তমান শিক্ষার্থীদের প্রবন্ধ, ছোটগল্প, কবিতা, বিজ্ঞান ও হল বিষয়ক লেখা স্থান পায়। একুশের বর্ণমালা, অমর একুশে হল সংসদের সাহিত্য বার্ষিকী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি হল সংসদের মধ্যে প্রথম সাহিত্য বার্ষিকী হিসাবে গত ২০ মার্চ, ২০২০ তারিখে প্রকাশের জন্য সকল প্রস্তুতি সমাপ্ত হলেও করোনা মহামারির জন্য বিশ্ববিদ্যালয় সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তা নির্ধারিত সময়ে প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে উক্ত সাহিত্য বার্ষিকীর মোড়ক উন্মোচন করা হবে। সাহিত্য বার্ষিকীতে অমর একুশে হলের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের লেখা সাহিত্যকর্ম স্থান পেয়েছে। এই দুইটি প্রকাশনা অমর একুশে হল সংসদের সাহিত্য সম্পাদক কাজী আরিফুর রহমানের ঐকান্তিক চেষ্টা ও পরিশ্রমের ফল।
হলে সর্বমোট ৩৮ জন কর্মচারী ও ৫ জন কর্মকর্তা রয়েছেন। কর্মচারীদের মধ্যে দারোয়ান ১৪ জন, বৈদ্যুতিক মিস্ত্রি ২ জন, মালি ২ জন, অফিস সহায়ক ৮ জন, পরিচ্ছন্নতা কর্মী ৭ জন, প্লাম্বার মিস্ত্রি ২ জন, কাঠ মিস্ত্রি ২ জন ও ১ জন লিফট ম্যান রয়েছেন। কর্মকর্তাদের মধ্যে ১ জন করে প্রিন্সিপাল এ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার, ইমাম খতিব, সিনিয়র এ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার, এ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার ও সিনিয়র গ্রন্থাগার সহকারী কাম টাইপিস্ট রয়েছেন।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে অমর একুশে হলের ছাত্ররা পড়ালেখার পাশাপাশি প্রগতিশীল আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রেখে চলেছেন। আমার বিশ্বাস, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় অমর একুশে হলের শিক্ষার্থীগণ তাদের মেধা ও মননের সফল প্রয়োগের মাধ্যমে একটি অসাম্প্রদায়িক ও উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনন্য ভূমিকা রাখবে । পরিশেষে, অমর একুশে হলের সাবেক ও বর্তমান সকল শিক্ষার্থী, আবাসিক শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দের সর্বাঙ্গীন মঙ্গল কামনা করছি।