প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসাবে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯২১ সালের ১ জুলাই ভারতের অন্যতম প্রদেশ, বাংলার পূর্বাঞ্চলীয় জেলাসমূহের মানুষের মধ্যে উচ্চশিক্ষা বিস্তারের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় অনুসরণ করে শিক্ষার্থীদের হলকেন্দ্রিক ভর্তি, আবাসনের ব্যবস্থা এবং আবাসিক শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে সমস্ত কার্যক্রম পরিচালনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন বৈশিষ্ট্য ছিল যা আজও অব্যাহত রয়েছে। আজকের ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি প্রতিষ্ঠাকালীন আবাসিক হল যথা ঢাকা, জগন্নাথ, এবং মুসলিম হলের (মুসলিম হল পরে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে রূপান্তরিত) মধ্যে অন্যতম। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ হল তথা ঢাকা হলের জন্ম ইতিহাস তৎকালীন ঢাকা কলেজের স্থানান্তরের সাথে জড়িত। ১৮৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত, ঢাকা কলেজ সদর ঘাটের একটি পুরানো বাড়ি থেকে ১৯০৮ সালের জুলাই মাসে আংশিক (পাঠাগার ও অন্যান্য স্থাপনা) এবং ১৯১১ সালে পরিপূর্ণভাবে ঢাকার রমনা এলাকায় স্থাপিত কার্জন হলে স্থানান্তরিত হয়। কার্জন হলের দক্ষিণ পাশে পুকুরের পশ্চিম পারে অবস্থিত দ্বিতল ভবনটি ঢাকা কলেজের ছাত্রাবাসে পরিণত হয়। নির্মাণের সময়, এটি ছিল ৪৩,৬৫০ বর্গফুট আয়তন বিশিষ্ট লাল ইট দিয়ে তৈরি একটি বর্গাকার বিল্ডিং। এটাই আজকের ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ হল তথা ঢাকা হলের মূল ভবন। কার্জন হল মূলত বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকালীন একটি নির্মাণ। ১৯০৪ সালে ভারতের ভাইসরয় লর্ড কার্জন এটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এবং সেই সময় এটি একটি টাউন হল হিসেবে প্রচলিত ছিল। কথিত আছে যে, বঙ্গভঙ্গের সময় এটি বিভক্ত পূর্ববাংলার পার্লামেন্ট ভবন হিসেবে নির্মিত হয়েছিল। পুকুর পারের ভবনটি খুব সম্ভবত সংসদ সদস্যদের আবাস হিসাবে নির্মান করা হয়। তবে, বঙ্গভঙ্গ রহিত হওয়ার কারনে, কার্জন হল কখনোই পার্লামেন্ট ভবন হিসেবে ব্যবহৃত হয়নি। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগে পরিণত হয়, যা আজও অব্যাহত রয়েছে।
ঢাকা কলেজ কার্জন হলে স্থানান্তরিত হলে কলেজের হিন্দু শিক্ষার্থীদের আবাসিক হল হিসাবে এটি ব্যবহৃত হত। পরে এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ধর্মনিরপেক্ষ (কসমোপলিটন) হলে রূপান্তরিত হয়। ১৯২১ সালে ঢাকা কলেজের হিন্দু ছাত্রাবাস ঢাকা হলে রূপান্তরের পর, হলটিতে জগন্নাথ এবং ঢাকা উভয় হলের শিক্ষার্থীদের আবাসনের ব্যবস্থা করা হয় এবং তা দীর্ঘকাল ধরে চলতে থাকে। ১৯৫৭-৫৮ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা হল জগন্নাথ হলের সঙ্গে তার যুক্ত পরিচয় থেকে আলাদা হয়ে যায়। প্রাথমিকভাবে হলটিতে ১৬০ জন ছাত্রের থাকার ব্যবস্থা ছিল। পরবর্তী পর্যায়ে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ঢাকা হলের দ্বিতল মূল ভবনে আরও একটি তল নির্মাণ করে এবং ৩১২ জন শিক্ষার্থীর থাকার ব্যবস্থা করে। যেহেতু এই হলটি ঢাকা কলেজের একটি ছাত্রাবাস পরিবর্তন করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তাই এটি প্রথমে "ঢাকা হল" নামে প্রবর্তিত হয় বলে প্রতীয়মান হয়। পরে ১৯৬৯ সালে, উপমহাদেশের প্রখ্যাত ভাষাতত্ববিদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের প্রথম প্রভোস্ট ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র মৃত্যুর পর তাঁর সম্মানে হলটির নামকরণ করা হয় “শহীদুল্লাহ্ হল”। সর্বশেষ ২০১৮ সালে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হলের নামটি পূণরায় পরিবর্তন করে "ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ হল" হিসেবে প্রবর্তন করেন। উল্লেখ্য যে, ১৯৪০ সালে প্রতিষ্ঠিত ফজলুল হক মুসলিম হলে পর্যাপ্ত আবাসন ব্যবস্থা না থাকায় ১৯৫২ সালে ঢাকা হলের মূল ভবনের পূর্ব অংশটি ফজলুল হক মুসলিম হলের সম্প্রসারণ হিসাবে ঘোষণা করা হয়। অবশ্য, ফজলুল হক মুসলিম হলের আবাসিক সমস্যা সমাধানের পরে ঢাকা হল তার মূল ভবনের পূর্বাংশ পুনরায় ফেরত পায়।
হলের বর্তমান আবাসিক ব্যবস্থা তিনতলা বিশিষ্ট মূল ভবনের সাথে আরও দুটি পাঁচতলা ভবন (শহীদ শরাফত আলী ভবন এবং শহীদ আতাউর রহমান খান খাদিম ভবন) সংযুক্ত করে নির্মিত। হল কমপ্লেক্সটি প্রায় ৫ একর জায়গা জুড়ে প্রতিষ্ঠিত এবং এতে বর্তমানে আবাসিক ও দ্বৈতাবাসিক সহ ১২৪০ জন এবং ১৩০০ জন অনাবাসী শিক্ষার্থী রয়েছে। মূল ভবনের উত্তর পার্শ্বে ১৯২৫ সালে নির্মিত লিটন হলটি, ঢাকা হল তথা ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ হলের প্রভোস্ট অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ঢাকা হল এবং লিটন হলের মধ্যবর্তী স্থানে "লিটন হল অডিটোরিয়াম" নির্মিত হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে, অডিটোরিয়ামটিতে হলের নিয়মিত সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকলাপ সংঘটিত হত। হলের প্রবীণ আবাসিক শিক্ষার্থীদের মতে, অডিটরিয়ামটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের অনেক আগে থেকেই শিক্ষার্থীদের কমন রুম হিসাবে ব্যবহৃত হত। উক্ত অডিটরিয়ামে নিয়মিত দৈনিক পত্রিকা, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক সাময়িকী ও রেডিও চালু থাকত এবং এতে ছাত্রদের ইনডোর ক্রীড়ার সুবিধাও ছিল। শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপে এটি সবসময় মুখরিত থাকত। মিলনায়তনটি বিগত শতাব্দীর আশির দশকে নামাজের স্থান হিসাবে মনোনীত হয় এবং ২০০৭ সালে নামাজের স্থান অন্যত্র স্থানান্তরিত হলে অডিটরিয়ামটি পূর্বের অবস্থা ফিরে পায়।
মূল ভবনের পশ্চিম পাশে একটি প্রশস্ত দ্বিতল ভবন রয়েছে যা ওল্ড ডাইনিং হল নামে পরিচিত। ১৯৬১ - ৬২ সালে, ডাইনিং হলটি আরও আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার ও মোজাইক করা হয়। ডাইনিং হলের নিচতলায় ছাত্রদের জন্য ডাইনিং এবং দুই ইউনিটের একটি মেস রয়েছে। ডাইনিংরুমের উত্তর পাশে আরও একটি রিডিং রুম চালু করা হয়। ডাইনিং এর দ্বিতীয় তলাটি একসময় হল মিলনায়তন ও কমনরুম হিসাবে ব্যবহৃত হত। আশির দশকে জগন্নাথ হলের দুর্ভাগ্যজনক দুর্ঘটনার পর ছাত্রদের সুরক্ষার কথা চিন্তা করে হল কর্তৃপক্ষ ২০০১ সালের ১০ মে কমনরুমটি সাময়িক ভাবে বন্ধ করে দেয়। পরে অবশ্য অস্থায়ীভাবে অডিটোরিয়ামের উত্তরাংশ শহীদ শরাফত আলী রিডিং রুম নামে খোলা হয়েছে। ২০০৭ সালে হল কর্তৃপক্ষ ডাইনিং হলের উপরের মিলনায়তনটি হল জামে মসজিদ হিসাবে চালু করে, যাতে ১০০০ মুসল্লি জামাতে নামাজ পড়তে পারেন। শহীদ আতাউর রহমান খান খাদিম ভবনের উত্তরে হলের প্রাক্তন প্রভোস্ট ড. আনোয়ারুল আজিম চৌধুরী স্মরণে তিন তলা ভবন নির্মিত হয়। এই ভবনে হল ছাত্র সংসদ ও অন্যান্য সামাজিক সংগঠনের অফিসসমূহ এবং টিভি-রুমের ব্যবস্থা রয়েছে। ভবনটির নিচতলা শিক্ষার্থীদের ক্যান্টিন ও মেস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। হল কমপ্লেক্সের অন্যান্য বিল্ডিংগুলির মধ্যে রয়েছে প্রোভস্ট বাংলো, গ্রন্থাগার, সেলুন, এবং শিক্ষক, কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের থাকার ব্যবস্থা। সবুজে ঘেরা এই হল কমপ্লেক্সটি এমনিতেই খুব সুন্দর। তদুপরি, একটি বিশাল খেলার মাঠ এবং একটি পুকুর হল কমপ্লেক্সের সৌন্দর্যকে বহুগুণে বাড়িয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাস্টার প্ল্যানের অংশ হিসাবে, শহীদুল্লাহ্ হলের শহীদ আতাউর রহমান খান খাদিম ভবনের স্থলে আধুনিক সুবিধাসহ একটি এগার তলা আবাসিক ভবন নির্মানের পরিকল্পণা করা হয়েছে, যা হলের বিদ্যমান আবাসিক সমস্যা লাঘব করবে বলে আশা করা যায়। তাছাড়া শহীদুল্লাহ্ হলের পুকুরের চারিধার আশপাশের স্থাপনা সমূহের সাথে সামঞ্জস্য রেখে সৌন্দর্যমণ্ডিত করার প্রকল্পও ইতোমধ্যে হাতে নেয়া হয়েছে।
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ হলের ইতিহাস ও ঐতিহ্য অতিশয় গৌরবময় ও খ্যাতিতে ভাস্বর। ১৯৪৭ এর দেশ ভাগের আন্দোলন, ’৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭১ এর মহান স্বাধীনতা যুদ্ধসহ ১৯৯০ এর গণআন্দোলনে এ হলের ছাত্রবৃন্দ তাঁদের দেশপ্রেম, ত্যাগ ও বীরত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। ১৯৬৪ সালে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আইয়ুবের অপশাসন ও দমনমূলক শিক্ষানীতিবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসাবে ঢাকা হলকে ঘিরে একটি বিশাল বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এই ঢাকা হলকেন্দ্রিক আন্দোলনের ফলস্বরূপ, আইয়ুবের সহযোগী দ্বারা আয়োজিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন পন্ড হয়ে যায়। ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারী স্বাধীনতাকামী জনতার আন্দোলনের সময় পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর বুলেটের আঘাতে শহীদ হন শহীদুল্লাহ্ হলের মেধাবী ছাত্র আসাদ এবং এই হত্যাকান্ডের পর ’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, সংঘটিত হয়। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রত্যুষে পাক হানাদার বাহিনীর গুলিতে শহীদ হন হলের প্রতিভাবান সহকারী আবাসিক শিক্ষক জনাব শরাফত আলী, গণিত বিভাগ ও জনাব আতাউর রহমান খান খাদিম, পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগ। তাঁরা দু‘জন পুরাতন ডাইনিং সংলগ্ন দোতলায় বসবাস করতেন। তাছাড়াও জালাল হায়দার নামে একজন শিক্ষার্থী হানাদার বাহিনীর আক্রমনে নিহত হয় বলে জানা যায়। এই হলের বহু সংখ্যক ছাত্র মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁদের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বীরবিক্রম খেতাব অর্জন করেন। পড়াশুনার পাশাপাশি শিল্প-সাহিত্য সংস্কৃতিতে, ক্রীড়াঙ্গনে এবং শৃঙ্খলায় এ হলের ছাত্রদের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। এ হলের কৃতি ছাত্ররা তাঁদের স্ব স্ব কর্মক্ষেত্রে স্বমহিমায় ভাস্বর হয়েছেন এবং দেশ মাতৃকার সেবায় নিজেদেরকে নিয়োজিত রেখেছে। এ হল থেকেই বেরিয়ে এসেছে অসংখ্য মেধাবী মুখ-যাঁরা পরবর্তীতে হয়েছেন সফল শিক্ষক, রাজনীতিবিদ, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, শিল্পী, খেলোয়াড়, মন্ত্রী-এমপি, সচিব আর দক্ষ প্রশাসক। ঢাকা হলের প্রথম প্রাধ্যক্ষ হন ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর এফ.সি. টার্নার। পরবর্তী প্রভোস্ট হন জি.এইচ. ল্যাংলি। ১৯২৪-২৫ সালে প্রভোস্ট হয়ে আসেন ওয়াল্টার এ. জেঙ্কিন্স। পরে ল্যাংলি ও জেঙ্কিন্স ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হন। এই হলের প্রাধ্যক্ষদের মধ্যে বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তিত্ব রয়েছেন যেমন - প্রফেসর সত্যেন্দ্রনাথ বসু, ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব প্রমুখ।