২০ জুলাই ২০২৫ রোববার সকাল ১০ টায় বাংলাদেশের প্রথিতযশা ভাস্কর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্য বিভাগের অনারারি অধ্যাপক মো. হামিদুজ্জামান খান ঢাকার ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত অবস্থায় ১৭ জুলাই ২০২৫ বৃহস্পতিবার হাসপাতালে ভর্তি হন। খ্যাতিমান শিল্পী ও শিক্ষক অধ্যাপক হামিদুজ্জামানের মৃত্যুতে বাংলাদেশের শিল্পাঙ্গন ও শিক্ষাক্ষেত্রে অপূরণীয় শূণ্যতা সৃষ্টি হলো। মৃত্যুর পর শেষ বিদায় জানাতে বিকাল ৩ টায় তাঁর মরদেহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ প্রাঙ্গণে নিয়ে আসা হয়। চারুকলা অনুষদ, ভাস্কর্য বিভাগসহ অনুষদের সকল বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভাস্কর্য প্রাক্তনি সংঘ, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ঢাকা আর্ট কলেজ, বেঙ্গল ফাউন্ডেশন, গ্যালারি কসমস, ভিত্তি-স্থপতিবৃন্দ, শান্ত-মরিয়ম ইউনিভার্সিটি অব আর্ট এন্ড টেকনোলজিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সংগঠন এবং ব্যক্তিগত ও দলগতভাবে শিল্পী, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও শুভানুধ্যায়ীবৃন্দ পুস্পস্তবক অর্পণ করে তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানায়। শ্রদ্ধাজ্ঞাপন শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে আসরের নামাজের পর তাঁর প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য, প্রো-উপাচার্য (শিক্ষা), প্রক্টর এবং চারুকলা অনুষদের ডিনসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ, ইনস্টিটিউট ও অনুষদের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দসহ সর্বস্তরের মানুষ তাঁর জানাজায় অংশ নেন। পরদিন ২১ জুলাই ২০২৫ সোমবার তাঁর জন্মস্থান কিশোরগঞ্জের কটিয়াদি উপজেলার সহশ্রাম গ্রামে দ্বিতীয় জানাজা শেষে তাঁকে তাঁর নির্মাণাধীন শিল্প সংগ্রহশালার কাছে পারিবারিক কবরস্থানে সমাধিস্থ করা হয়।
অধ্যাপক হামিদুজ্জামান খান জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি। কিশোরগঞ্জের গচিহাটায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পাঠ সম্পন্ন করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভূক্ত তৎকালীন চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয় (বর্তমান চারুকলা অনুষদ)-এর শিক্ষার্থী হন। ১৯৬৭ সালে চিত্রকলায় স্নাতক হন। ভাস্কর্য বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষক অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের সাহচর্যে প্রাথমিক অনুশীলন শেষে ১৯৭০ সালে তিনি শিক্ষক হিসেবে বিভাগে যোগ দেন। ১৯৭৬ সালে ভারতে বরোদার এমএস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাস্কর্যে স্নাতকোত্তর পাঠ সম্পন্ন করেন। ১৯৮৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক স্কাল্পচার সেন্টারে ভাস্কর্য বিষয়ে এক বছরের উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি ২০১২ সালে অধ্যাপক হিসেবে অবসর গ্রহণ করলেও অনারারি অধ্যাপক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্য বিভাগের সাথে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যুক্ত ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজি (বুয়েট)-এর স্থাপত্য বিভাগসহ কয়েকটি খ্যাতিমান বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগে ভাস্কর্য বিষয়ে পাঠদান করেছেন। তিনি বাংলা একাডেমি ও বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির ফেলো ছিলেন।
বাংলাদেশের আধুনিক ধারায় ভাস্কর্য ও চিত্রকলায় তাঁর অবদান অনন্য। ভাস্কর্য চর্চায় তাঁর খ্যাতি দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও প্রসারিত। দেশে-বিদেশে বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিগত সংগ্রহে রয়েছে তাঁর বহুসংখ্যক শিল্পকর্ম। দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলসহ বিভিন্ন স্থানে তাঁর বেশ কিছু মুক্তাঙ্গন ভাস্কর্য রয়েছে। রাষ্ট্রপতির বাসভবন ও দপ্তর বঙ্গভবনের ’পাখী পরিবার’ (১৯৮২), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক ভাস্কর্য ’সংশপ্তক’ (১৯৯০) সহ প্রায় তিন শতাধিক মুক্তাঙ্গন ভাস্কর্য দেশে-বিদেশে স্থাপিত হয়েছে। ঢাকার পাশে গাজীপুর জেলায় তাঁর ভাস্কর্য নিয়ে নির্মিত হয়েছে ‘হামিদুজ্জামান ভাস্কর্য উদ্যান’। বিভিন্ন করপোরেট ভবনের সামনে অথবা স্থাপত্যের অভ্যন্তরে রয়েছে তাঁর অনবদ্য সব শিল্পকর্ম। তিনি স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে ভাস্কর্য চর্চার বিষয় হিসেবে বেছে নেন মুক্তিযুদ্ধকে। তাঁর ’স্মরণ ৭১’ সিরিজের ভাস্কর্যগুলো বাংলাদেশের দৃশ্যশিল্পের ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ নির্মাণ। তাঁর গড়ন ও পরিসর ভিত্তিক ইস্পাতের বিমূর্ত ধারার ভাস্কর্যগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশে আধুনিক ধারার ভাস্কর্যের ধারণা নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
তিনি কোরিয়া, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ভাস্কর্য সিম্পোজিয়াম, বিয়েনাল ও ট্রিয়েনালে অংশ নেন। দেশে-বিদেশে শিল্পী হামিদুজ্জামান খানের ৩০টির অধিক একক শিল্পকর্ম প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রায় অসংখ্য যৌথ প্রদর্শনীতে তাঁর শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধ, ভাস্কর্য ও শিল্পশিক্ষায় অবদানের জন্য ২০০৬ সালে তাঁকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত জাতীয় ভাস্কর্য প্রদর্শনীতে তিনি শ্রেষ্ঠ ভাস্কর হিসেবে পুরস্কৃত হন। এছাড়াও দেশ ও বিদেশে তিনি অনেক পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হন। তাঁর জীবন ও শিল্পকর্ম নিয়ে বেশ কিছু উল্লেখ্যযোগ্য গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণাধর্মী বেশকিছু প্রবন্ধ ও অভিসন্দর্ভে তিনি গুরুত্বের সাথে আলোচিত হয়েছেন।
মৃত্যুকালে তিনি সহধর্মিণী ভাস্কর আইভি জামান ও দুই পুত্রসহ অসংখ্য স্বজন, ভক্ত ও গুনগ্রাহী রেখে যান। আমৃত্যু শিল্পী ও শিক্ষক অধ্যাপক হামিদুজ্জামানের জীবনাবসানে বাংলাদেশের শিল্পজগৎ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ভাস্কর্য বিভাগ অপূরনীয় ক্ষতির সম্মুখীন হলো।